সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ঠিকাদার মাফিয়া সাব্বির মাহমুদ

# বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পে নজিরবিহীন জালিয়াতি
# মাদানির কেরামতিতে রাতারাতি সিমুলেশন ব্যবসায়ী বনে যান তার শ্যালক হাবিব
# ডিপিএম মেথডে কোটি কোটি টাকার নীতিবহির্ভুত ক্রয়
# সিমুলেশন খাতের একক মাফিয়া হয়ে উঠেছেন সাব্বির
# পর্দার আড়ালে সকল অবৈধ লেনদেনের নির্দেশ সাব্বিরের
তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী। চাকরিজীবী হয়েও দেশের ঠিকাদার জগতের সিমুলেটর স্থাপন খাতে একক আধিপত্য তার। আইন অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবী হয়ে সরাসরি ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত থাকার সুযোগ না থাকায় নামে বেনামে করেছেন একাধিক কোম্পানি। এসব কোম্পানিতে আবার নিজের আপন শ্যালকের নামে ট্রেড লাইসেন্স করিয়ে পর্দার আড়াল থেকেই এসব ব্যবসা পরিচালনা করছেন তিনি। শ্যালক একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ব্যবসায়ী হলেও রাতারাতি তার কাধে দেওয়া হয় সিমুলেশন ব্যবসা। এদিকে কয়েকটি ডামি কোম্পানি তৈরি করে আবার সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বিপুল অংকের লেনদেন করে কাজ বাগিয়ে নেন ওই কর্মকর্তা। বলছিলাম নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ এর কথা। নৌখাত ও ঠিকাদার পাড়ায় এই কর্মকর্তা নিজ নামে পরিচিত না থাকলেও এ খাতের ‘সাব্বির মাদানি’ নামেই সবাই তাকে চেনেন। এমন তথ্যই উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।
অনুসন্ধান বলছে- মেরিন একাডেমির প্রশিক্ষক থাকাকালীন আবাসন খাতেও তার ব্যবসা ছিল। ঐ ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় অনেক ব্যক্তির নিকট থেকে এপার্টমেন্ট দেয়ার নাম করে নেয়া কয়েক কোটি টাকা তার নিকট বিভিন্ন লোকজন প্রাপ্য ছিল। যা তিনি নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে পরিশোধ করেন। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা হয়ে তিনি যেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ পেয়ে যান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে- ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ মেরিন একাডেমি নটিক্যাল বিভাগের প্রশিক্ষক থাকা অবস্থায় মেরিন একাডেমির সাবেক কমান্ড্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সাজিদ হোসেন এর সাথে মিলে তারা মেরিন একাডেমিতে সর্বপ্রথম কোটি কোটি টাকার সিমুলেটার স্থাপন করে। তাদেরকে সহায়তা করে ভারতীয় কোম্পানি এআরআই সিমুলেশন। এদিকে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ কানাডা প্রবাসী ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম, সাব্বির মাদানী এবং এআরআই সিমুলেশন পরস্পর যোগসাজ করে কোটি কোটি টাকার সিমুলেটর ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে স্থাপন করে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশ রিজিওনাল ওয়াটারওয়ে ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট-১ এর কন্ট্রাক্ট নাম্বার- বিআরডব্লিউটিপি-জি৩সি এর আওতায় 'প্রোকিউরমেন্ট অব ফুল মিশন ব্রিজ সিমুলেটর উইথ ফিশিং এন্ড ড্রেজিং এন্ড ফুল মিশন সিমুলেটর উইথ ইঞ্জিন এন্ড লিকুইড কার্গো হ্যান্ডেলিং ফিচারস ফর ডিইপিটিসি নারায়নগঞ্জ' নামের এই টেন্ডারটিতে নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির করে কাজ নিয়েছেন ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ ওরফে মাদানি সাব্বিরের প্রতিষ্ঠান ইরেকটর্স। এই কোম্পানিটি তার আপন শ্যালক কাজী হাবিবুল হোসেন এর নামে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। তবে পর্দার আড়াল থেকে এ কোম্পানির সকল কার্যক্রম ক্যাপ্টেন সাব্বির পরিচালনা করছেন এসবের বিস্তর প্রমাণ এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে এ প্রকল্পের জি ৩ সি কোডের দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে জালিয়াতি, কোটি টাকার বিনিময়ে কাজ নেওয়া, টেন্ডার ডকুমেন্টে সই ছাড়া জমা দিয়েও পার পাওয়া, অবৈধভাবে জাল সই করা, পর্যাপ্ত এলসি না খোলাসহ নানা প্রমাণ উঠে এসেছে। এসব অনিয়ম নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। তার মাধ্যমেই ডিপিএম পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম কোটি কোটি টাকার সিমুলেটর ব্যবসা শুরু হয়।
প্রতিবেদকের হাতে আসা অপর একটি ডকুমেন্টস এ দেখা গেছে- সেখানে ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ নিজেকে ইরেকটর্স এর পরামর্শক হিসেবে কথা বলছেন। তবে সেখানেও নিজে ইরেকটর্স থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদকে হাতে আসা একাধিক তথ্য প্রমান বলছে - সাব্বির মাহমুদ এই টেন্ডারের বিষয় সকল পরিকল্পনা করছেন। একইসাথে সকল অবৈধ লেনদেন তার নির্দেশেই হয়েছে।
টেন্ড লাইসেন্সেও নয় ছয়:
অনুসন্ধানে দেখা গেছে এআরআই-ইরেকটর্স জয়েন্ট ভেঞ্চার এর ট্রেড লাইসেন্সে নজিরবিহীন জালিয়াতির প্রমান মিলছে৷ এ ট্রেড লাইন্সেসে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে একই প্রতিষ্ঠানের নামে দুইবার ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে৷ সূত্র বলছে বিশেষ স্বার্থে দুইবার এই ট্রেড লাইসেন্স করা হয়।
বিডার হয়েও নিজেই স্পেসিফিকেশন তৈরি করলেন সাব্বির
অনুসন্ধানে দেখা গেছে- এ দরপত্রের স্পেসিফিকেশন তৈরীতে নানা জালিয়াতি করা হয়েছে৷ আইন অনুযায়ী- প্রকল্প পরিচালক ও দরপত্রের পরামর্শকদের এই স্পেসিফিকেশন তৈরী এবং এ গোপনীয়তা বজায় রাখার কথা। কিন্তু খোদ এ দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এআরআই-ইরেকটর্স জয়েন্ট ভেঞ্চারই গোপনে এই স্পেসিফিকেশন তৈরি করেছেন। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাখা হলেও সেই প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্পেসিফিকেশন তৈরী করে জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রকৌশলী আইয়ুব আলী এই স্পেসিফিকেশন তৈরির দায়িত্ব দেয় খোদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এআরআই-ইরেকটর্সকে। এরপর পর্দার আড়ালে থাকা ইরেকটর্স এর মূল মালিক ও নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ ও নথি অনুসারে মালিক কাজী হাবিবুল হোসেন ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এআরআই সিমুলেশন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট (অপারেশন) ক্যাপ্টেন অমিত ভট্রাচার্য মিলে এই স্পেসিফিকেশন তৈরী করে৷ পরবর্তীতে এআরআই-ইরেকটর্স জেভির এর এই তৈরী করা স্পেসিফিকেশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্যাডে তাদের সীলমোহর ও সাক্ষর নেন প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলী৷ এই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকেই প্রকল্প পরিচালক মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত:
অভিযোগ রয়েছে, যোগসাজশের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় বিদেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারেনি। প্রি-বিড মিটিংয়ে নরওয়ের কনসবার্গসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ইমেইলের মাধ্যমে পকল্প পরিচালক বরাবর লিখিতভাবে আপত্তি জানালেও কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। অপরদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের ইমেইলের উত্তর তৈরী করে দেয় এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ ও এআরআই এর ক্যাপ্টেন অমিত ভট্রচার্য৷ তাদের তৈরী এই উত্তরই প্রকল্প পরিচালক সংশ্লিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে পাঠিয়ে দেয়৷ এদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রকিউরমেনট রুলস অনুযায়ী সব যোগ্য প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। বিশ্বব্যাংকের কাছে এই ধরনের অনিয়ম প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকে “মিস প্রকিউরমেনট” ঘোষণা করতে পারে।
স্বাক্ষরবিহীন টেন্ডার ডকুমেন্টস:
আইন অনুযায়ী প্রকল্পের টেন্ডার ডকুমেন্টস জমা দেবার সময় টেন্ডার ডকুমেন্টসের প্রতি পৃষ্ঠায় এআরআই-ইরেকটর্স জয়েন্ট ভেঞ্চারের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তির সীলমোহর ও সই বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু অনুসন্ধান বলছে - দরপত্র দাখিলের সময় তারা কোন সাক্ষর ও সীলমোহর ব্যতীত এসব টেন্ডার ডকুমেন্টস সাবমিট করেছিল। পরবর্তীতে টেন্ডার মূল্যায়নের পূর্বমুহুর্তে এসব বিষয় প্রকল্প পরিচালকের নজরে এলে সে টেন্ডার আইনভাবে বাতিল না করে অত্যন্ত সুকৌশলে এআরআই-ইরেকটর্স জয়েন্ট ভেঞ্চারের মালিক কাজী হাবিবুল হোসেনকে তার অফিস কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে গোপনে এসব সই ও সীলমোহর করান৷ সই করার সময় প্রচুর নথিপত্র থাকায় কাজী হাবিবুল হাসান এসব ডকুমেন্টসের আংশিক সই করেন আর বাকি অংশে জাল সই করেন তার এক কর্মচারী৷ অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮-এর ধারা ৩০(৪) অনুযায়ী, যে কোনো টেন্ডার ডকুমেন্ট যথাযথভাবে স্বাক্ষরিত না হলে তা বাতিলযোগ্য। পিপিআর ২০০৮-এর ধারা ১২৮ অনুযায়ী, ভুয়া বা অকার্যকর ডকুমেন্টস জমা দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকলিস্ট ও চুক্তি বাতিলের সুপারিশ করা যেতে পারে। অথচ প্রকল্প পরিচালকের মদদে ডকুমেন্ট জমা দেবার লম্বা সময় পর এসব সই করে এআরআই-ইরেকটর্স জয়েন্ট ভেঞ্চার।
সিন্ডিকেটের দখলে প্রকল্প
ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীর প্রশিক্ষণ থাকাকালীন একাডেমির তৎকালীন কমান্ডেন্ট ড. সাজিদ হুসাইন এর জোগসাজশ করে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে সিমুলেটর স্থাপন করে৷ ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ গোপনে এই ব্যবসায় ব্যবহার করে তার স্ত্রীর বড় ভাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাবিবুল হোসেন এর প্রতিষ্ঠান ইরেকটর্সকে৷ এভাবেই সিমুলেশন সেক্টরে দুর্নীতির শেকড় গাড়ে ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদের প্রতিষ্ঠান ইরেকটর্স৷ এতে সরাসরি সহযোগিতা করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এআরআই সিমুলেশন৷ পরবর্তীতে এই সিন্ডিকেটটি ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটেও সিমুলেশনের কাজ করে৷ এ কাজে সরাসরি সহায়তা করে বর্তমানে কানাডা প্রবাসী ও ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট এর সাবেক অধ্যক্ষ ও প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম৷ এই পুরো টিমকে সরাসরি মদদ দিতো সাবেক নৌ মন্ত্রী শাহজাহান খান৷
এদিকে এই টেন্ডারে যে সমস্ত বিদেশী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল তাদের স্থানীয় এজেন্টরা অবিলম্বে এই চুক্তিটি বাতিল করে রিটেন্ডার করার জন্য দাবি জানিয়েছেন ।











